ডিলারশিপ ব্যবসা। অনেকের মুখেই এ ধরনের ব্যবসার নাম শুনেছেন। আজ আমরা আলোচনা করব ডিলারশিপ ব্যবসা কি? কিভাবে শুরু করবেন ডিলারশিপ ব্যবসা?এই ব্যবসার নিয়ম কি? ডিলারশিপ ব্যবসা করতে কত টাকা পুঁজি প্রয়োজন হয়? কিভাবে ডিলারশিপ ব্যবসায় টিকে থাকবেন? চলুন শুরু করা যাক.......
কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা এলাকায় কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে তাদের পন্য বিপণন করাই হল মূলত ডিলারশিপ ব্যবসা। সহজ ভাষায় বললে কোনো কোম্পানির পন্য খুচরা অথবা পাইকারি বিক্রেতার কাছে বিক্রি করার ব্যবসাই হল ডিলারশিপ ব্যবসা। আর কেউ যদি কোনো কোম্পানির ডিলারশিপ নেয় তাহলে তাকে ঐ কোম্পানির ডিলার বলা হবে। একটি এলাকায় কোনো কোম্পানির কোনো পন্যের জন্য ডিলার সাধারণত একজনই হয়। কিন্তু একজন ব্যক্তি একাধিক কোম্পানির ডিলার হতে পারেন।
প্রথমেই উল্লেখ করে নেই এই ব্যবসায় ঝুঁকি কম এবং ব্যবসা বুঝতে পারলে লাভও তুলনামূলক বেশি। ঝুঁকি কম হওয়ার কারণটা বলছি... ধরুন আপনি গাজীপুর জেলায় কোনো এক কোম্পানির সয়াবিন তেলের ডিলার। এখন আপনি ১০০০ লিটার সয়াবিন তেল কোম্পানি থেকে এনেছেন। কিন্তু বিক্রি করেছেন ৯০০ লিটার। অপরদিকে আপনার বাকি ১০০ লিটার তেলের মেয়াদও শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন ঐ ১০০ লিটার তেলের দায়ভার কিন্তু আপনার নয়। আপনি এগুলো কোম্পানি থেকে পুনরায় আনতে পারবেন। এ নিয়মটির ব্যতিক্রমও হতে পারে তবে সেটা চুক্তির উপর নির্ভর করবে। আপনি যদি কোনো কোম্পানির ডিলার হন তাহলে কোম্পানি আপনার কাছে সবচেয়ে কম মূল্যে পন্য বিক্রি করতে হবে। এগুলো চুক্তি করে নিতে হয়। সুতরাং ডিলারশিপ ব্যবসায় নামতে হলে দেখে শুনে বুঝে নামতে হবে নতুবা ব্যবসায় ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যদি কোনো বড় অথবা প্রসিদ্ধ কোম্পানির ডিলার হতে পারেন সেটাই ভালো হবে। কারণ অনেক সময় দেখা যায় যে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দেখে কোনো কোম্পানির ডিলারশিপ পাওয়ার জন্য প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করে শেষে পুরো টাকাই জলে গিয়েছে। এভাবে প্রতারকদের পাতা ফাঁদে পা দিবেন না। ডিলারশিপ ব্যবসা করতে হলে আপনাকে দেখেশুনে করতে হবে। অর্থাৎ আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দেখেই এ ব্যবসায় বিনিয়োগ করবেন না। যাচাই-বাছাই করে নিবেন।
এবার আসি ডিলারশিপ ব্যবসা কিভাবে শুরু করবেন... ডিলারশিপ ব্যবসার নিয়ম কি......
কোনো কোম্পানির যখন কোনো অঞ্চলে ডিলার প্রয়োজন হয়, তারা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে। তাদের ওয়েবসাইটে, ইন্সটাগ্রাম, লিংকড-ইন, ফেসবুক পেইজে অথবা পোস্টারের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করে থাকে। সেখানে আবেদনের নিয়ম দেয়া থাকে। কোনো কোম্পানির ক্ষেত্রে অনলাইনে আবেদন করতে হয়, কোথাও সরাসরি আবার কোথাও দুভাবেই আবেদন করা যায়। আবেদনের পর কোম্পানির লোকজন আপনার আবেদন যাচাই-বাছাই করে আপনাকে ডিলার নিয়োগ দিবে। আর ডিলারশিপ ব্যবসায় কত টাকা পুঁজি প্রয়োজন হবে সেটা সুনির্দিষ্ট নয়। কোম্পানি কত বড়, তাদের সুনাম, বেচা কিনি কেমন তার উপর ভিত্তি করে কোম্পানিগুলো আপনার কাছ থেকে বিনিয়োগ চাইবে। ১০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করা লাগতে পারে। ডিলার হিসেবে বিনিয়োগ করার পূর্বে কোম্পানির অফিস কারখানা সব ঘুরে আসবেন। ডিলারশিপ ব্যবসায় বিনিয়োগের পদ্ধতি প্রধানত দু ধরনের হয়ে থাকে।
১.সিকিউরিটি মানি ইনভেস্টমেন্ট।
এ টাকাটা কোম্পানি আপনার কাছ থেকে ডিপোজিট রাখবে। আর এ টাকা কিন্তু একেবারের জন্য নিয়ে নিবে না। আপনার সাথে কোম্পানির ডিলারশিপের চুক্তি শেষ হয়ে গেলে ফেরত দিয়ে দিবে। কত টাকা সিকিউরিটি মানি ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে নিবে সেটা কোম্পানি কত বড় এবং তাদের বেচা-কেনা কি-রকম তার উপর নির্ভর করে। কোনো কোম্পানির চাহিদা ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা আবার কোনো কোম্পানির চাহিদা ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকাও হতে পারে। যদি কেউ এ ব্যবসায় নতুন নামে তাহলে তার খুব বেশি টাকা ইনভেস্ট না করাই ভালো হবে। এবং প্রথমেই বেশি টাকা দিয়ে বড় কোম্পানির ডিলার না হওয়ার পরামর্শই আমরা দিব।
২. পন্যের খরচের কিছু অংশ বিনিয়োগ
অর্থাৎ আপনি যে পন্য ক্রয় করবেন তার মূল্যের একটা অংশ আপনাকে অগ্রিম বিনিয়োগ করতে হবে এবং বাকি টাকাটা পরে অর্থাৎ আপনার পন্য বিক্রির পরে পরিশোধ করতে হবে।
উপরে উল্লেখিত দুভাবেই এ ব্যবসা করা যায়। কোনো কোম্পানি প্রথম উপায়ে ডিলার নিয়োগ দেয় আবার কোনো কোম্পানি দ্বিতীয় উপায়ে।
আর ডিলারশিপ ব্যবসা মূলত চুক্তি নির্ভর। আপনি কত দিনের জন্য ডিলার সেটাও চুক্তি করে নিতে হবে। এছাড়া আরও কিছু শর্ত যেমন দাম, মেয়াদোত্তীর্ণ পন্যের বিষয়, আপনার অঞ্চলের সীমানা এই সকল বিষয় নিয়ে স্ট্যাম্প করে নিবেন। কখনও কোম্পানি মেয়াদোত্তীর্ণ পন্য ফেরত নেওয়ার সময় পুরো পরিবহন খরচ দেয় কখনও আংশিক খরচ দেয় আবার কখনও দেয়না। এসকল বিষয় নিয়ে কোম্পানির সাথে আলোচনা করে চুক্তি করে নিবেন। প্রায় সময় দেখা যায় যে চুক্তি না থাকার কারনে হঠাৎ ডিলারশিপ বাতিল হয়ে যায়। এতে করে ব্যবসায়ীদেরকে বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হয়। সুতরাং ঠিকমতো চুক্তি করে নিবেন আর যদি বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেন তাহলে কোনো আইনজীবীর সাহায্য নিবেন।
ডিলারশিপ ব্যবসা শুরু করতে আপনার একটি গোডাউন লাগবে। তারপর একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ট্রেড লাইসেন্স এর দরকার হবে।
এবার আসি এস আর নিয়ে। ডিলারশিপ ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটি। এস আর মানে হচ্ছে সেলস রিপ্রেজেনটেটিভ। অর্থাৎ বিক্রয় প্রতিনিধি। অনেক ডিলারশিপ ব্যবসায়ীরা একা পন্য বিপণন করতে পারেনা। তাদেরকে এস আর তথা বিক্রয় প্রতিনিধি নিয়োগ দিতে হয় এবং এই বিক্রয় প্রতিনিধিরাই ব্যবসায়ী বা গ্রাহকদের কাছে পন্য পৌঁছে দেয়। এখন সমস্যা হচ্ছে এস আর নিয়োগ কে দিবে? কোম্পানি নাকি ডিলার? এটার সমাধান হল চুক্তি। প্রথমে কোম্পানির সাথে যে চুক্তি করেছেন সেখানে উল্লেখ করবেন যে এস আর কে নিয়োগ দিবে? যদি কোম্পানি নিয়োগ দেয়, সেটাতো ভালো। আপনাকে অতিরিক্ত ঝামেলা পোহাতে হবেনা কিন্তু ডিলারশিপ কমিশনটা একটু কম পাবেন। আর যদি আপনাকে এস আর নিয়োগ দিতে হয় সেটাও খারাপ নয়, আপনি আপনার পছন্দমত এস আর নিয়োগ দিবেন পাশাপাশি ডিলারশিপ কমিশনটা বেশি পাবেন।
তারপর আসি কোন ধরনের পন্যের ডিলারশিপ নেওয়া যায়? এবং কোন ধরনের পন্যের ডিলারশিপ নিলে লাভজনক হবে?
ইলেকট্রনিক পন্য যেমন ফ্রিজ, ফ্যান, লাইট, ইলেকট্রিক তার, আয়রন, ওয়াশিং মেশিন এসব পন্যের ডিলারশিপ নেওয়া যেতে পারে। এ ব্যবসা অনেক লাভজনক হবে যদি আপনি কোনো বড় ব্রান্ডের ডিলার হতে পারেন। খাদ্যপন্য যেমন ব্রেড, চিপস, চানাচুর, বিভিন্ন ধরনের চকলেট, বিস্কুট ইত্যাদি জাতীয় খাদ্যপন্যের ডিলারশিপ নেওয়া যেতে পারে। তবে এ ধরনের পন্যের ডিলারশিপ ব্যবসা পুরোপুরি ব্রান্ড ভ্যালুর উপর নির্ভর নয়। বাংলাদেশের অনেক স্থানেই বড় বড় ব্রান্ডের ফুড প্রোডাক্টের চেয়ে স্থানীয় ফুড প্রোডাক্টগুলোর ব্যবসা ভালো চলে। সুতরাং এক্ষেত্রে আপনাকে বুদ্ধিমত্তার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। দক্ষ এস আর নিয়োগ দিতে হবে। তারপর মোটরসাইকেলের ডিলারশিপও নিতে পারেন। এটাও ডিলারশিপ ব্যবসাগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় একটি ব্যবসা। সফট ড্রিংকস এবং মিনারেল ওয়াটারের ডিলারশিপও নিতে পারেন। কৃষি পন্যের ব্যবসাও ঊর্ধমুখী। সুতরাং এখানেও ডিলারশিপ নিতে পারেন।
ডিলারশিপ ব্যবসায় আপনি কোন পর্যায়ে থাকবেন সেটা আপনার ব্যবসার পরিকল্পনা, মার্কেট প্লানিং এবং সঠিক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে। আর এ ব্যবসায় অভিজ্ঞতা অনেক বড় কিছু। সুতরাং লেগে থাকতে হবে এবং সুযোগ বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাহলেই আপনি সফল হতে পারবেন। আর ডিলারশিপ ব্যবসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আপনার নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা। কর্মীদেরকে সবসময় হাসিখুশি রেখে তাদের থেকে সর্বোচ্চ কাজ আদায় করে নেওয়া। আপনাকে আপনার অধীনস্থদেরকে চাপ না দিয়ে সুন্দরভাবে কাজ আদায় করতে হবে।
আর আপনি যদি কর্মীদের চাপ দিয়ে কাজ আদায় করেন তাহলে প্রথমদিকে লাভবান হলেও পরে বড় ধরনের লোকসান গুনতে হবে।
উপরে উল্লেখিত ব্যবসা সম্পর্কে যদি কোনো মতামত বা প্রশ্ন থাকে অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন। ধন্যবাদ।